ইলেক্ট্রন প্রোটনের গতিশীলতা – পার্টিকেল এক্সেলারেটর

পদার্থ বিজ্ঞানের গবেষণার স্তর অনেক সূক্ষ্ম স্তরে এসে পৌঁচেছে। বিজ্ঞানীদের গবেষণার বিষয়বস্তু এখন অণু পরমাণুতে সীমাবদ্ধ নেই। অণু পরমাণু গঠনকারী উপাদান নিয়ে এখন কাজ চলছে। এ ধরনের উপাদানকে বলা হয় সাব এটমিক কণা। এ ধরনের সূক্ষ্মতর কণা নিয়ে পরীক্ষা চালাতে বিশাল বিশাল যন্ত্রপাতি কাজে লাগানো হচ্ছে। উদাহরণ স্বরূপ, বাবল চেম্বার, পার্টিকেল এক্সিলারেটর-এর নাম বলা যেতে পারে। এখানে পার্টিকল এক্সিলারেটর সম্পর্কে ধারণা দেবার চেষ্টা করা হলো।
পার্টিকল এক্সিলারেটর এক ধরনের ডিভাইস। দ্রুত গতিসম্পন্ন বিম, চার্জিত এটমিক বা সাব এটমিক কণা প্রস্তুতসহ অন্যান্য গবেষণা উপলক্ষ্যে এদের ব্যবহার করা হয়। পরমাণুর নিউক্লিয়াসের গঠন, নিউক্লিয়াসে ক্রিয়াশীল বলের ধরণ, বিশেষ কিছু পরমাণুর (ইউরেনিয়াম পরবর্তী ভারী ধাতু) গঠন আবিষ্কারে পার্টিকল
এক্সিলারেটর ব্যবহৃত হয়েছে এবং হচ্ছে, এছাড়া, বিভিন্ন বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে এদেরকে কাজে লাগানো হচ্ছে। শিল্প কারখানায়, ক্যান্সার চিকিৎসায়, জৈব বস্তু জীবাণুমুক্ত করতে, প্লাস্টিকের পলিমার উৎপাদনে, রেডিও কার্বন ডেটিং প্রক্রিয়ায়ও পার্টিকল এক্সিলারেটর কাজ করছে। এছাড়া এলিমেন্টারি বলের গবেষণায় এগুলো ব্যবহৃত হচ্ছে।
পার্টিকল এক্সিলারেটরের সাহায্যে দ্রুত গতিসম্পন্ন ইলেকট্রন, প্রোটন উৎপন্ন করা হয়। এ ধরনের ডিভাইসের দক্ষতা নির্ভর করে উৎপন্ন কণার গতি শক্তির উপর। গতিশক্তিকে শক্তির একক দ্বারা প্রকাশ করা হয়। যে কোনো বস্তুর গতি শক্তি বস্তুর ভরের উপর নির্ভরশীল। সাব এটমিক কণার ভর নগণ্য। এদের গতিশক্তিও অল্প থাকে, তাই ইলেকট্রন ভোল্ট (eV)-এর মতো ক্ষুদ্র ইউনিট দ্বারা এদের গতিশক্তি প্রকাশ করা হয়। একটি ইলেকট্রনের সমপরিমাণ চার্জ সম্পন্ন কণাকে ১ ভোল্ট বিভব পার্থক্যে স্থাপন করলে কণাটি যে গতিশক্তি প্রাপ্ত হয় তা ১eV-এর সমান। এর বড় এককগুলো হচ্ছে কিলো (১০৩) eV, মেগা (১০৬) eV, গেগা (১০৯) eV, টেরা (১০১২) eV। এ ধরনের গতিশক্তি অর্জনে কণাগুলোকে অনেক দূরত্ব পাড়ি দিতে হয়। উদাহরণস্বরূপ, সবচে’ ছোট্ট একটি আয়ন এক্সিলারেটরে একটি কণা প্রতি সেকেন্ডে ৮,০০০ কি.মি. পথ পাড়ি দেয়।
গঠন
পদার্থবিদ্যা সহ আরো অন্যান্য ক্ষেত্রে পার্টিকল এক্সিলারেটর একটি কাজের জিনিস হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। তাই এ ধরনের ডিভাইসকে আরো উন্নত করার চেষ্টা করা হয়েছে। এদের প্রতিটির গঠন আলাদা। তবে, প্রতিটির এমন কিছু যন্ত্রাংশ আছে যাদেরকে একই উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয়। এ ধরনের ডিভাইসের মূল উপাদান তিনটি।
১. পার্টিকলের উৎস, ২. গতিশীল কণা চলাচলের জন্য একটি শূন্য প্রকোষ্ট, ৩. কণার গতি নিয়ন্ত্রণে একটি ইলেকট্রিক ফিল্ড থাকতেই হবে। ফিল্ডের ধরন অনুসারে এ ধরনের ডিভাইসকে দু’টিভাগে ভাগ করা হয়ে থাকে। লিনিয়ার এক্সিলারেটর (কণাটিকে সরল পথে চলানো হয়) এবং সাইক্লিক এক্সিলারেটর (কণাটি বৃত্তকার পথে ঘুরে)। সাইক্লিক এক্সিলারেটরে ইলেকট্রিক ফিল্ডের সাহায্যে কণার গতি পথ বাঁকানো হয়, বাঁকানোর ধরন সর্পিলাকার বা বৃত্তকার হতে পারে।
নিচে বিভিন্ন ধরনের পার্টিকল এক্সিলারেটর সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো-
১. কনস্ট্যান্ট ভোল্টেজ এক্সিলারেটর : সাধারণ একটি এক্সিলারেটর। গঠন প্রকৃতি লিনিয়ার। এ ধরনের এক্সিলারেটরের দু’ধরনের গঠন হতে পারে।
ক. ভোল্টেজ মাল্টিপ্লায়ার : এর আবিষ্কারক হচ্ছেন ককক্রফট ও ওয়াল্টন। এর সাহায্যে ৭১০ কিলো eV শক্তিসম্পন্ন প্রোটন তৈরি করা হয়। এ গতিশক্তির প্রোটন লিথিয়ামের সাথে নিউক্লিয়ার বিক্রিয়া ঘঠাতে পারে। কৃত্রিমভাবে গতিশক্তি প্রাপ্ত কণার উপর নিউক্লিয়ার বিক্রিয়ার প্রভাব পরীক্ষায় ডিভাইসটি ব্যবহৃত হয়েছে। এজন্য ১৯৫১ সালে পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।
খ. ভেনডিগ্রাফ জেনারেটর : এতে একটি ইনস্যুলেটিং বেল্ট, বেল্ট চালনার জন্য পুলি, চার্জ তৈরি করতে ধাতব চিরুনি ব্যবহার করা হয়। বেল্টে উৎপন্ন চার্জ উচ্চ বিভব প্রান্তে প্রবাহিত করা হয়। ডিভাইসটিতে উচ্চ চাপের গ্যাস ব্যবহার করা হয় এবং একে চার্জিত করা হয়, চার্জিত গ্যাসের প্রভাবে আয়ন উৎস হতে ত্বরিৎ কণা নির্গত হয়।
২. বেটাট্রন : এ ডিভাইসের সাহায্যে শুধুমাত্র দ্রুত গতির ইলেকট্রন তৈরি করা হয়। ইলেকট্রন বেটা পার্টিকল নামেও পরিচিত। ডিভাইসটি তাই এমন। এটি একটি সাইক্লিক এক্সিলারেটর অর্থাৎ ইলেকট্রিক ফিল্ড ব্যবহার করে ইলেকট্রনকে বৃত্তাকারে ঘোরানো হয়। এর সাহায্যে প্রায় ৩০০ মেগা eV শক্তিসম্পন্ন ইলেকট্রন তৈরি করা সম্ভব। এত শক্তির ইলেকট্রনের সাহায্যে পাই মেসন তৈরি করা যায়।

বাণিজ্যিকভাবে বেটাট্রন হার্ড (শক্তিশালী) এক্সরে তৈরিতে ব্যবহৃত হচ্ছে। চিকিৎসায় শিল্পেও এ ধরনের এক্সরে কাজে লাগে।
৩. সাইক্লোট্রনস : এটি ম্যাগনেটিক রেজোন্যান্স এক্সিলারেটর। ইহা দু’ধরনের হয়ে থাকে-
ক. ক্ল্যাসিক্যাল
খ. সিনক্রোসাইক্রোটনস
ক. ক্ল্যাসিক্যাল : ছোট সিলিণ্ডারের মতো দেখতে একটি আয়ন উৎস থাকে। একে একটি শূন্য চেম্বারের মাঝামাঝি স্থানে বসানো হয়। আবার, আয়ন উৎসকে একটি বিদ্যুৎ চুম্বকের মাঝে স্থাপন করা হয়। এতে ব্যবহৃত ভোল্টেজ সোর্স অসসিলেটর হিসেবে কাজ করে। উৎপন্ন কণাগুলো বৃত্তাকার পথে ঘুরে এবং এদের গতিশক্তি ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে। কণাগুলোর গতিপথ দেখতে সেমি সার্কলের সর্পিলাকার সিরিজের মতো। অর্থাৎ সার্কলগুলোর ব্যাসার্ধ ক্রমশঃ বাড়তে থাকে। এভাবে ২৫ মেগা eV শক্তিসম্পন্ন প্রোটন তৈরি করা হয়।
খ. সিনক্রোসাইক্রোটনস : এ ধরনের সাইক্রোটনে কণার ত্বরনের সাথে সাথে ভোল্টেজ সোর্সের কম্পাঙ্ক পরিবর্তিত হয়। তাই এদের ডিভাইসকে ফ্রিকোয়েন্সি মডিউলেটেড সাইক্রোটনসও বলা হয়। পাই মেসনের সেকেন্ডারি বিমের মতো জটিল কাজে এর ব্যবহার সীমাবদ্ধ রয়েছে। কারণ, এটি অত্যন্ত ব্যয়বহুল। এটি ১ গাইগা eV শক্তিসম্পন্ন কণা তৈরি করতে পারে।
৪. লিনিয়ার রেজেন্যান্স এক্সিলারেটর : এ ডিভাইসে উচ্চ শক্তিসম্পন্ন কম্পাঙ্ক উৎস ব্যবহৃত হয়। এরা দু’ধরনের হয়ে থাকে- স্থির তরঙ্গ লিনিয়ার এক্সিলারেটর (প্রোটনের মতো ভারী কণার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়) এবং অগ্রগামী তরঙ্গ লিনিয়ার এক্সিলারেটর (ইলেকট্রনের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়)।
লিনিয়ার ইলেকট্রন এক্সিলারেটর : ৩০০০ মেগাহাটর্জ কম্পাংকের একটি বিদ্যুৎ চুম্বক ক্ষেত্রের সাহায্যে ইলেকট্রনকে শক্তি প্রদান করা হয়। একটি শূন্য সিলিন্ডারের ওয়েভ গাইড হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এ ধরনের পরিবেশে তড়িৎ চুম্বকীয় তরঙ্গের দশা বেগ শূন্যস্থানে আলোর বেগের চেয়ে বেশি হয়ে থাকে। এমতাবস্থায় তরঙ্গের বেগ কমানোর জন্য সিলিন্ডারের ভেতর ধাতব কালার বসানো হয়।
এধরনের ডিভাইসের সাহায্যে উচ্চ গতিশক্তি সম্পন্ন (৫০ গিগা eV) ইলেকট্রন ও পজিট্রন তৈরি করা হয়। এমনি একটি লিনিয়ার ইলেকট্রন এক্সিলারেটর হচ্ছে স্টানফোর্ড লিনিয়ার এক্সিলারেটর সেন্টার, সংক্ষেপে এসএলএসি। ইতোমধ্যে এ ধরনের ডিভাইসের ধাতব কাঠামো তৈরিতে সুপারকন্ডাক্টর ব্যবহার শুরু হয়ে গেছে। এতে শক্তি অপচয় কম হয়।
লিনিয়ার প্রোটন এক্সিলারেটর : ১৯৬৪ সালে লুইস আলভারেজ এর ডিজাইন প্রস্তাব করেন। এতে একটি লম্বা ধাতব ট্যাঙ্কে স্থির তরঙ্গ তৈরি করা হয়। এতে প্রায় ২০০ মেগাহার্টজের তরঙ্গ ব্যবহার করা হয়। প্রতিটি ট্যাঙ্কে অনেকগুলো টিউব, ড্রিফট টিউব থাকে।

প্রচুর প্রোটন উৎপাদন ডিভাইসটির অন্যতম সাফল্য। এ ধরনের ডিভাইস তৈরিতে খরচ পড়ে প্রচুর। তাই, মেসনের মতো দুর্লভ কণা প্রস্তুত করতে এ যন্ত্রকে কাজে লাগানো হয়। নিউইয়র্কের ব্র“ব হাভেন ন্যাশনাল ল্যাবরেটরি এবং বাটাভিয়ায় অবস্থিত ফার্মি ন্যাশনাল এক্সিলারেটর ল্যাবরেটরি পৃথিবীর বৃহত্তম দু’টি লিনিয়ার প্রোটন এক্সিলারেটর। দ্বিতীয় প্রতিষ্ঠানটি সংক্ষেপে ফার্মিল্যাব নামেও পরিচিত।
সিনক্রোটনস : সর্বাধুনিক এক্সিলারেটর। দু’ধরনের সিনক্রোটনস দেখা যায়- ইলেকট্রন সিনক্রোটনস ও প্রোটন সিনক্রোটনস।
অন্যান্য আরো ডিভাইস আছে। এদের মাঝে clliding beam storage rigns, impulse accelerator অন্যতম।

শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট