ছয়টি বিশেষ সংখ্যা নিয়ন্ত্রন করছে আমাদের মহাবিশ্ব



আমাদের মহাবিশ্ব নিয়ন্ত্রিত হয় মাত্র ছয়টি সংখ্যা দিয়ে যেগুলো বিন্যস্ত হয়েছে বিগ ব্যাংগের সময়কালে। সেগুলোর যেকোন একটিও ব্যতিক্রম ঘটলে কোন গ্রহ, নক্ষত্র এবং মানব জাতির অস্তিত্ব ই থাকতো না।
– বিশিষ্ট জ্যোতির্বিদ স্যার মারটিন রিজ।
আমাদের দৈনন্দিন পৃথিবীর সকল রসায়ন এবং অস্তিত্ব মূলত নির্ধারণ হয় অনু(এটম)র ধর্ম, তাদের আকার এবং ভর, তাদের ধরন, বিভাজন এবং সেই অমোঘ  বলের দ্বারাই যা তাদের একত্রিত করে রাখছে । এটম বা অনুর অস্তিত্বের মূলে আছে তার অভ্যন্তরীণ বল এবং নানাবিধ কণা।
আবার গ্রহ, নক্ষত্র গ্যালাক্সি বা ছায়াপথ এসবের সবই নিয়ন্ত্রিত হয় মধ্যকর্ষন শক্তি বা বলের মাধ্যমেই এবং জ্যোতির্বীদদের  গবেষনার মূল বিষয়সমূহ অর্থাৎ গ্রহ, নক্ষত্র গ্যালাক্সি বা ছায়াপথ।
তাত্ত্বিক গণ ও
গবেষকগণ  চান ফিজিক্যাল সূত্র সমূহের সারকে সুনির্দিষ্ট সমীকরণ এবং কিছূ সুনির্দিষ্ট সংখ্যার মাধ্যমে আবদ্ধ করে সহজে প্রকাশ করতে। এই কাজে তাদের আরও অনেক অনেক পথ যেতে হবে যেমন সত্যি তেমনি সত্যি তাদের বর্তমান সফলতাও দৃঢ়তার সাথে উল্লেখ করার মতোই। তারই অংশ হিসেবে তাদের নিরলস গবেষনায় বিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে এমন ছয়টি সংখ্যা নির্ণয় করা সম্ভব হয়েছে যা বিশেষভাবে দৃষ্টিহরণ করে নেয়। ছয়টি সংখ্যার মধ্যে দুটি সাধারন বলের সাথে সম্পর্কিত । আরও দুটি সংখ্যা মহাবিশ্বের আকৃতি, বিণ্যাস সুর্নির্দিষ্ট করনের পেছনে এবং  অনন্ত স্থায়ীত্বের জন্যে দায়ী। আর বাকী দুটি নিজস্ব স্থানের ধম (properties of space itself ) সুর্নির্দিষ্ট করেছে।
এই ছয়টি সংখ্যা কে আমরা বলতে পারি মহাবিশের গঠনের রেসিপি। যদি এদের একটির কোন ব্যতিক্রম ঘটে বা যথাযথ মানে না থাকে তবে কোন নক্ষত্র বা জীবনের অস্তিত্ব সম্ভব নয়।
তবে বিজ্ঞানীদের ধারনা আমাদের এই মহাবিশ্বের বাইরে অন্য কোন অজানা মহাবিশ্বের ও অস্তিত্ব থাকতে পারে। হয়তো সেখানে এই সংখ্যা অনুপুস্থিত বা তার মান অন্যরকম ।
আশ্চর্যের বিষয় অতি সামান্য কৃষ্ণগহ্বর হতে এই আমাদের মহাবিশ্বের উদ্ভব এবং যার প্রসারণের পরে মাত্র কয়েকটি  সংখ্যা আমাদের বসবাস যোগ্য অস্তিত্ব ও স্থায়ীত্ব সম্পন্ন এই বর্তমান মহাবিশ্বকে টিকিয়ে রেখেছে।
হয়তো সংখ্যাগুলোর মধ্যে কোন পারস্পরিক সম্পর্ক থাকলেও থাকতে পারে। এই মুহূর্তে সে ব্যাপারে বিশদ অজ্ঞতার কারনে বিজ্ঞানীরা বিস্তারিত বলতে পারছে না। এখানে আলোচনায় এই ছয়টি সংখ্যাকে হাইলাইট করার পেছনে মূল কারন হচ্ছে এই সংখ্যাগুলির প্রত্যেকটি মহাজগতে বেশ কঠিন এবং ব্যতিক্রম ভূমিকা পালন করছে । শুধু তাই না। এরা একত্রে  মিলেই নির্ধারণ করে মহাবিশ্বের বিবর্ধন বা ক্রম প্রসারণ এবং এর অন্তর্নিহিত কার্যক্ষমতার সরূপ।

প্রথম সংখ্যাঃ

এই সংখ্যাটিকে প্রকাশ করা হয় N দিয়ে। এটা দুইটি বলের অনুপাত। অনু মধ্যস্থিত আন্ত বল (strength of the electrical forces that hold atoms together) কে তাদের মধ্যস্থ মধ্যকর্ষন বল (the force of gravity between them) দিয়ে ভাগ করে এই সংখ্যাটি পাওয়া যায় । N একটি অতি বিশাল সংখ্যা যাতে একের পরে ৩৬টা শূণ্য থাকে। অর্থাৎ ১০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০। প্রকৃতির এই বিশাল সংখ্যাটির কারনেই মহাবিশ্বের ব্যাপকতা। যদি সংখ্যাটিতে একটিও কম শূণ্য থাকত তাহলে মহাবিশ্বে কেবল মাত্র ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কিছু সংখ্যক জীবই থাকত এবং  জীবনের বিবর্তন সম্ভবই হতোনা।

দ্বিতীয় সংখ্যাঃ

এই সংখ্যাটিকে প্রকাশ করা হয় ε (এপসাইলন) দিয়ে। এই সংখ্যাটি একটি পরিমাপ যা প্রকাশ করে আনবিক নিউক্লিয় (atomic nuclei) বন্ধন দৃঢ়তা এবং পৃথিবীর সকল অনুর উদ্ভব।  এই সংখ্যাটির মান ০.০০৭। যদি সংখ্যাটি হতো ০.০০৬ অথবা ০.০০৮ তাহলে আমাদের অস্তিত্ব বিপ্নন হতো।
একটু সহজ ভাবে এই ধ্রুবকটির অস্তিত্ব খুঁজতে চেষ্টা করি-
হাইড্রোজেনের নিউক্লিয়াসে থাকে একটি প্রোটন আর হিলিয়ামের নিউক্লিয়াসে থাকে দুইটি প্রোটন আর দুইটি নিউট্রন।
আমরা জানি চারটে হাইড্রোজন মিলে একটা হিলিয়াম গঠন হয়। অতি সংক্ষেপে এটাই ফিউশন যা সূর্য পৃষ্ঠে নিয়ত ঘটছে এবং হাইড্রোজেন ভেঙে হিলিয়াম হচ্ছে।
চারটা প্রোটনের ভর অর্থাৎ চারটা হাইড্রোজেন নিউক্লিয়াসের ভর ৬.৬৯০ X ১০২৪ আর হিলিয়ামের নিউক্লিয়াসের ভর ৬.৬৪৩ X ১০২৪ , যা চারটে প্রোটনের ভরের থেকে .০০৭ ভাগ হালকা।
যা প্রমাণ করে  হাইড্রোজেন থেকে হিলিয়ামের ফিউশনের সময় সূর্যের ভরের ০.০০৭ % শক্তিতে রূপান্তরিত হয়।
এর থেকে তাত্ত্বিকভাবে প্রমাণ করা যায় সূর্য ১০০ বিলিয়ন বছর এইভাবে আলো বিতরণ করবে। কিন্তু বাস্তবে সূর্যের মাত্র ৭০% হাইড্রোজেন হওয়ায় এই বছর হিসেব করা হয় আসলে ৯ বিলিয়ন বছর।

তৃতীয় সংখ্যাঃ

এই সংখ্যাটিকে প্রকাশ করা হয় Ω (omega) দিয়ে। এটি একটি মহাজাগতিক নাম্বার। সংখ্যাটি মহাবিশ্বের মোট পদার্থের (galaxies, diffuse gas, and dark matter) পরিমাণ নির্দেশ করে। এই সংখ্যাটি নির্ধারণ করে মহাবিশ্বের প্রসারণের হার এবং মহাজগতের পরিণাম । অর্থাৎ  মাধ্যকর্ষন শক্তি এবং মহাবিশ্বের বিবর্ধন শক্তির মধ্যে সম্পর্ক প্রকাশ করে ওমেগা ।
যদি মহাবিশ্বের গড় ভর-ঘনত্বের (average mass-density) পরিমাণ প্রতি ঘনমিটারে পাঁচ অনুও বৃদ্ধি পেত তাহলে মহাবিশ্বের ঘনত্ব এতটাই বেড়ে যেত যে সময়ের সাথে সাথে মহাবিশ্বের প্রসারণ থেমে যেত কারন সেক্ষেত্রে মধ্যকর্ষন শক্তি
( gravity) প্রসারন বা বিবর্ধন শক্তি( expansion energy) ছাড়িয়ে যেত এবং অবশ্যই মহাবিশ্ব আকস্মিক ধ্বংস হতো।
কিন্তু যেহেতু এক্সপেনশন এনার্জি  গ্রাভিটির উপরে থাকে তাই মহাবিশ্ব অনন্তকাল প্রসারণ হতেই থাকে।
Critical density সেই ভর-ঘনত্ব-নির্দেশ করে যেখানে মহাবিশ্ব ঠিক ধ্বংস সংকোচন ও অনন্ত প্রসারনের সীমানায় থাকবে। এবং সেক্ষেত্রে মহাবিশ্বের আকার হবে সমতল বা ইউক্লিডিয়ান জিওমেট্রির মতো।
Ω (omega) হচ্ছে critical density এবং actual density র অনুপাত। পূর্ণ  critical density তে Omega  = ১। বর্তমানে গড় ঘনত্ব  (  The average density) কমপক্ষে ০.৩ ধরা হয়। যদি ধরি এখন ওমেগা কমপক্ষে ০.৩ তাহলে মানতে হবে অবশ্যই বিগ ব্যাংগের ১ দুই সেকেন্ড পরে ১ এর থেকে খুব বেশী দূরে ছিলনা। একক বা এক থেকে দূরে সরে যাবার পেছনে মূল কারন প্রসারণ(expansion)।  তাই যদি  ১ থেকে বেশী হয়ে যায় মধ্যকর্ষন শক্তি প্রসারন শক্তির থেকে বেশী হয়ে যাবে আবার এ থেকে বেশ কমে গেলে উল্টোটা হবে অর্থাৎ ওমেগা ০( শূণ্য) র দিকে যেতে থাকবে। ধরি একটা মুহূর্তে ওমেগার মান ০.,৫। এই মান ০.২৫ এ নামবে যখন মহাবিশ্ব প্রসারিত হবে দ্বিগুণ। কিন্তু যেহেতু ওমেগা এখন ধরা হচ্ছে ০.৩ , তার মানে বিগব্যাংগের পরে এর থেকে খুব বেশী দূরে সরেনি।

চতুর্থ সংখ্যাঃ

এই সংখ্যাটি প্রকাশ করা হয় λ (Lambda)  দিয়ে। এটি  মহাবিশ্বের একটি বিরুদ্ধ মধ্যকর্ষীয় বল (anti-gravity force)। অধূনা (১৯৯৮ সালে) আবিষ্কৃত এই সংখ্যাটি মহাবিশ্বের প্রসারণ নিয়ন্ত্রন করে। যদিও উল্লেখ করেতেই হয় যে বিলিয়ন আলোকবর্ষের নিচের স্কেলে এই সংখ্যার কোন বোধগম্য প্রভাব নেই।
পরিণামে এই সংখ্যার প্রভাবই মহাবিশ্বের উপর মধ্যকর্ষন ও অন্যান্য বলের চেয়ে বেশী প্রকট হবে কারন সময়ের সাপেক্ষে মহাবিশ্ব অধিক আধার ও খালি খালি হয়ে যাবে।
ল্যম্বডা খুবই ছোট একটি সংখ্যা। যদি এটির মান সামান্যতমও বৃদ্ধি পায় তবে বিলিয়ন আলোক বর্ষের নিচের স্কেলে মহাবিশ্বকে প্রভাবিত করতো এবং ছায়াপথ ও নক্ষত্রের গঠন বন্ধ করে দিত । ফলে মহাজাগতি বিবর্তন(Cosmic evolution) কখনই সম্ভব হতোনা।

পঞ্চম সংখ্যাঃ

এই সংখ্যাটি প্রকাশ করা হয় Q দিয়ে। Q, যার উপর আমাদের মহাবিশ্বের বিন্যাস এবং গঠন নির্ভরশীল, হলো দুইটি মৌলিক শক্তির অনুপাত। এর পরিমাপ ১/১০০০০০।
এটা যদি আরও ক্ষুদ্র হতো মহাবিশ্ব হতো নিষ্ক্রিয় এবং আকারহীন (inert and without structure) হত। যদি ইহা একটুও বেশী হতো মহাবিশ্ব হয়ে যেত এক ভয়ানক স্থান যেখানে কোন নক্ষত্র বা সোলার সিস্টেম থাকতো না।

ষষ্ঠ সংখ্যাঃ

এই সংখ্যাটি প্রকাশ করা হয় D দিয়ে। D এর মান ৩। এই সংখ্যাটি মহাবিশ্বের স্বাভাবিক মাত্রাগুলোকে (dimensions) প্রকাশ করে। মহাবিশ্বের ডাইমেনশন যদি ১ বা ২ হতো তাহলে কোন জীবনের অস্তিত্ব থাকতো না। সময় হচ্ছে চতুর্থ ডাইমেনশন (আমি কোথায় যেন পরেছি যে সময় সপ্তম ডাইমেনশন)। সময়ের একটি নির্দিষ্ট দিক আছে এবং যা সম্মুখ গামী। তাই একে এখানে ধরা হয়নি। কিন্তু এই তিনটি ডাইমেনশনের তেমন দিক নাই।
এরূপ আরও কিছু ধ্রুব সংখ্যা আছে যা আমাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখে। এই ছয়টি সংখ্যা বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন বিশিষ্ঠ জ্যোতির্বিদ স্যার মার্টিন রিজ তার বিখ্যাত বই Just Six Numbers এ। তিনি এবং আরও অনেক পদার্থবিদ এবং জ্যোতির্বিদ  নিরলস চেষ্টা ও গবেষণা করে যাচ্ছেন এই ধ্রুব সংখ্যাগুলোর মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন করার জন্য। যে সম্পর্ক কে তারা আখ্যায়িত করতে চান “Theory of Everything” নামে।

শেয়ার করুন

লেখকঃ

পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট